ঢাকাবুধবার , ৯ জুলাই ২০২৫

ডাকসু নির্বাচন : প্রয়োজনীয়তা, অপ্রয়োজনীয়তা, সংকট এবং করণীয়

মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী
জুলাই ৯, ২০২৫ ৫:৪৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদসমূহের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবেগের নাম। প্রতিবছর ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে- এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হবার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কারিকুলামের পাশাপাশি এক্সট্রা-কারিকুলার যেসব কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের প্রতি বছরের একাডেমিক ক্যালেন্ডারের অংশ হবার কথা ছিল- শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র চর্চার মূল ক্ষেত্র ডাকসু হলো তার মধ্যে সর্বপ্রধান। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতাকে অস্বাভাবিক করে দিয়ে ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১০২ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মোট ৩৬ বার এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর মাত্র ৮ বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে হিসেবে সাদা চোখে দেখলে যে শিক্ষার্থী সমাজের উপর ভর করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হয়েছে, সেই শিক্ষার্থী সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকারের চরম লুণ্ঠন হলো ডাকসু নির্বাচনের এই অনিয়মিত অনুষ্ঠান।

কেন এই অনিয়মই বর্তমানে অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে? এর রাজনৈতিক উত্তর নানাজন নানাভাবেই দিয়ে থাকেন, সময়ে-অসময়ে তা বদলে যেতেও দেখা যায় অহরহ। কিন্তু ডাকসু’র এই অচলাবস্থা সৃষ্টির পেছনে গঠনতান্ত্রিক এবং আইনি যেসব জটিলতা কাজ করছে যা কিনা বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীদের আধুনিক ও উদার গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত- সেগুলো নিয়ে তেমন কোন আলোচনা বা লেখালেখি দেখা যায় না। অথচ নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত ডাকসু’র মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই কার্যকরীভাবে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে এসব গঠনতান্ত্রিক ও আইনি পরিবর্তন আসা বাধ্যতামূলক এবং তার জন্য প্রয়োজন সেসব বিষয়ে উপযুক্তভাবে ব্যাপকহারে আলোকপাত করা।

এক্ষেত্রে সবার প্রথমে যে বিষয়টিতে আলোকপাত করতে হয় তা হলো- ডাকসু ও হল সংসসমূহের গঠনতন্ত্র কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ অনুসারে প্রতিবছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কোন সরাসরি বাধ্যবাধকতা সত্যিকার অর্থে নেই। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন-ক্ষণ ঠিক করার বিষয়ে গঠনতন্ত্রটির অনুচ্ছেদ ৮(ই) অনুযায়ী ডাকসুর সভাপতি (পদাধিকারবলে উপাচার্য)-কে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া আছে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন আলোচনা, সংলাপ বা পরামর্শ ব্যতিরেকেই মনমর্জিমাফিক যখন ইচ্ছা তখন ডাকসু নির্বাচনের দিন-ক্ষণ নির্ধারণ ও ঘোষণা করার এখতিয়ার রাখেন উপাচার্য। তাই ডাকসু নির্বাচন এত বছর পর পর অনুষ্ঠিত হলেও তাতে করে গঠনতন্ত্রের কোন বিধান লঙ্ঘন হয়নি। আবার ভবিষ্যতে ডাকসু ও হলও সংসদসমূহের গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ৫(এ) অনুসারে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে যেকোন বাহানা দেখিয়ে উপাচার্য ডাকসু’র নির্বাচিত নির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত করে অনুচ্ছেদ ৬(সি) অনুসারে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে মনমর্জিমাফিক পুনঃনির্বাচন ঘোষণা করলেও গঠনতন্ত্রের কোন বিধান লঙ্ঘন হবে না- যা স্পষ্টতই একটি অগণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিচায়ক।

এদিকে নির্বাচনের দিন-ক্ষণ নিয়ে কোন সরাসরি বিধান না থাকলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদে আসীন থাকার সময়সীমা ঠিকই বেঁধে দিয়েছে বর্তমান গঠনতন্ত্র। এর অনুচ্ছেদ ৬(সি) অনুযায়ী ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ৩৬৫ দিনের জন্য নির্বাচিত হবেন। আবার পরবর্তী নির্বাচন এই ৩৬৫ দিনের ভেতরে অনুষ্ঠিত না হলে তাঁরা আরও ৯০ দিন অথবা নির্বাচনের দিন- যেইদিন আগে হবে সেইদিন পর্যন্ত পদে আসীন থাকতে পারবেন। উক্ত ৯০ দিন পার হয়ে গেলে নির্বাচিত ডাকসু প্রতিনিধিদের পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্য ঘোষিত হবে।

প্রসঙ্গত যোগসূত্র টানার স্বার্থে আরেকটি তথ্য সামনে আনা দরকার বোধ করি:- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ এর আদেশ নং ১৯ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ ধরণের Authority বা কর্তৃপক্ষ রয়েছে, যথা:- (ক) সিনেট; (খ) সিন্ডিকেট; (গ) একাডেমিক কাউন্সিল; (ঘ) অনুষদ; (ঙ) কোর্স কমিটি; (চ) অ্যাডভান্সড স্টাডিজ বোর্ড; (ছ) অর্থ কমিটি; (জ) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি; (ঝ) নির্বাচন বোর্ড; এবং (ঞ) বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি দ্বারা ঘোষিত অন্যান্য কর্তৃপক্ষ। এই কর্তৃপক্ষসমূহের মধ্যে একমাত্র সিনেট বাদে বাকি একটিতেও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের থাকার কোন বিধান নেই, যা নিতান্তই অন্যায্য। আবার একই আইনের আদেশ নং ২০(১) (এল) অনুসারে সিনেটে ডাকসু’র ৫ জন প্রতিনিধি থাকতে পারবেন। কিন্তু এই বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হবার কোন বিধান না থাকায় সভাপতি তথা উপাচার্যের ইচ্ছাস্বাধীন মনোনয়নেই সেই ৫ জন প্রতিনিধি নির্বাচন হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বিগত ২০১৯ সালের প্রহসনের ডাকসু নির্বাচনের পরে সিনেটের সদস্য হিসেবে মনোনীত ৫ জন প্রতিনিধির মধ্যে নূরুল হক নূর বাদে সকলেই ছিলো ছাত্রলীগের নেতা। তাদের মধ্যে দুইজন তথাকথিত নির্বাচনে “জয়ী” এবং বাকি দুইজন ছিলো অনির্বাচিত ছাত্রলীগের উচ্চপদস্থ নেতা (বাংলা ট্রিবিউন; ১৪ জুন, ২০১৯)।

দিনশেষে ডাকসু ও হল সংসদসমূহের গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ নং ৫(এ), ৬(সি) ও ৮(ই) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ এর আদেশ নং ১৯ ও ২০(১) (এল) একসাথে পড়লে এটিই প্রতীয়মান হয় যে- নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকলেও ডাকসু’র সভাপতি পদকে ব্যবহার করে উপাচার্য স্বেচ্ছাচারিভাবে যাকে ইচ্ছা সিনেটে ডাকসু’র প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে কার্যত শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত কোন প্রতিনিধি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারেন। আবার এ বিষয়ে ডাকসু’র নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কোন প্রতিবাদ করলে সাথে সাথে নির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন নির্বাচন দিতে বা না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতেও কোনপ্রকার বাঁধা নেই।

শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিপরীতে এমনসব প্রচন্ড স্বৈরাচারী ক্ষমতা একজন শিক্ষক বা প্রশাসকের উপর ন্যস্ত করার সোজা-সরল মানে দাঁড়ায় শিক্ষক-প্রশাসকদেরকে ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর মতন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে তুলে শিক্ষার্থীদেরকে উপনিবেশের প্রজাদের মতন অধিকারহীন অবস্থায় রাখার পথ সুগম করা। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সংগ্রাম ও ত্যাগের ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যায় প্রচন্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এদেশের প্রতিটি সংকটকালে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছে এবং সংকটকাল পার হলে নিজেদের মধ্যকার কুলাঙ্গার অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে সর্বোচ্চ সচেতনতা দেখিয়েছে। এর বিপরীতে হালের জুলাই আন্দোলন সহ বাংলাদেশের সকল সংকটকালে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য হলেও সংকট পরবর্তীকালে তাঁদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষত ২০২৪ সালের ০৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্তৃক ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নির্যাতন এবং জুলাই-আগস্ট মাসে গণহারে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা হত্যার বিষয়টিকে

সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে সরাসরিভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিষয়ে চরম নীরবতা ও বিচারহীনতার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের জন্য একটি কলঙ্কের দাগ হয়ে রইবে।

এমনই আরেকটি কলঙ্কের দাগ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত শিক্ষকেরা তৈরী করছেন ডাকসু ও হল সংসদসমূহের গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়ে চরম অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতা দেখিয়ে। যেখানে ডাকসু ও হলও সংসদসমূহকে সত্যিকার অর্থেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আঁতুড়ঘর হিসেবে পুনর্গঠনের জন্য এই সংস্কার কার্যক্রমে তাঁদের পান্ডিত্যপূর্ণ এবং সচেতন ভূমিকা কাম্য ছিলো, সেখানে তাঁদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবনা এসেছে তা চরমভাবে হতাশাজনক এবং এমন দায়সারা, পক্ষপাতদুষ্ট ও স্বেচ্ছাচারী সংস্কার বাস্তবায়িত হলে সেগুলো ডাকসু’র ভবিষ্যতকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন পথেই নিয়ে যাবে। তাই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের ফোরামে প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অন্যায্য ও একচ্ছত্র আধিপত্যমূলক হস্তক্ষেপ আদতে কোন সুবিবেচনার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না। এজন্য ডাকসু’র সভাপতি হিসেবে উপাচার্য এবং হল সংসদসমূহের সভাপতি হিসেবে প্রাধ্যক্ষদের পদাধিকারবলে থাকার বিধান এবং উভয় সংসদে কোষাধ্যক্ষ শিক্ষকদের মধ্য থেকে মনোনীত হবার বিধান সংস্কার করে ডাকসু’র সকল পদে সরাসরি শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান তৈরী করা এখন সর্বজনসম্মত সময়ের দাবি।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুন্দর সমাধান করা যেত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রস্তাবনা অনুসারে ডাকসু ও হল সংসদসমূহের সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ পদ দুইটিকে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে শিক্ষক, প্রশাসক, এলামনাই ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হলে। সে উপদেষ্টা পরিষদ যেমন শিক্ষার্থীদের সংসদসমূহকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অংশীদারকে ঐক্যবদ্ধভাবে একই ফোরামে আনবে, তেমনি প্রয়োজনবোধে সিন্ডিকেট বরাবর গঠনতন্ত্র সংস্কারের প্রস্তাবনা দেয়ার মতন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষমতা এর উপর অর্পণ করা যাবে। এতে করে গঠনতন্ত্রকে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যকরী অংশীদারদের মতামত নেয়া সম্ভব হবে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত নানাবিধ সংস্কার এনে ডাকসু’কে আধুনিক একটি ছাত্র সংসদে রূপান্তর করা যাবে।

আবার অন্যদিকে মৌলিক এসব সংস্কারের আলোচনাকে একেবারে দৃষ্টিকটুভাবে এড়িয়ে যেয়ে নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করার পক্ষে অনেকেই আজকাল সটান দাঁড়িয়ে গেছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও কম হারে পক্ষপাতমূলক সংস্কার করার একটা অজুহাত দাঁড় করানো হয়েছে যে- “কিছু সংস্কার এখন করে নিয়ে ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বাকি সংস্কার করবেন, আপাতত মৌলিক সংস্কার করে নির্বাচন হবে”। এক্ষেত্রে আশংকাজনক ব্যাপার হলো, শিক্ষক বা শিক্ষার্থী যারাই এ ধরণের কথা বলছেন, তাঁরা ডাকসুর গঠনতান্ত্রিক সংস্কারের ব্যাপারে মোটেই জ্ঞান রাখেন না, অথবা জ্ঞান রাখলেও সুনির্দিষ্ট কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা এরকম বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য ছড়াচ্ছেন। কারণ একে তো উপরের আলোচনা অনুসারেই বুঝা যাচ্ছে যে ডাকসু’কে কার্যকরী করার লক্ষ্যে যেসব সংস্কার করার দরকার তার ধারেকাছেও এই প্রশাসন যায়নি, তার উপরে ডাকসু ও হল সংসদের বর্তমান গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ নং ১৬ অনুসারে গঠনতন্ত্র সংস্কারের একচ্ছত্র ক্ষমতা শুধুমাত্র সিন্ডিকেটের হাতেই রেখে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সিন্ডিকেটকে ডাকসু কিংবা বাইরের কোন ফোরাম থেকে নির্দিষ্ট পরামর্শ বা দাবি জানাবার কোন নিয়মও রাখা হয়নি। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩

এর আদেশ নং ২৩ অনুযায়ী সৃষ্ট সিন্ডিকেটে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের কোন সুযোগও রাখা হয়নি। তাই ডাকসু’র গঠনতন্ত্রের ১৬ নং অনুচ্ছেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ এর আদেশ নং ২৩ সংস্কার না করলে নির্বাচিত প্রতিনিধি আসলেও গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়ে তাঁদের কোন এখতিয়ার থাকবে না।

সংকটের আলোচনাতে সবার শেষে একটি বিষয়ে জোর না দিলে অন্যায় হবে। তা হলো হল সংসদসমূহের গঠনতন্ত্র সংস্কার। বর্তমান প্রশাসন এবং ২০১৯ সালের ফ্যাসিবাদের পদলেহনকারী প্রশাসন সহ যখনই দায়সারা সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, প্রত্যেকবারই কেন্দ্রীয় সংসদের সংস্কারের মূলা দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়াস খ্যাত হলসমূহের শিক্ষার্থী সংসদকে করা হয়েছে চরম অবহেলা। ফলে হল সংসদসমূহের গঠনতন্ত্র রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক ও অগণতান্ত্রিক বিধানে ভরা একটি অন্ধকূপ। বিশেষত হল সংসদসমুহের গঠনতন্ত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক ও অগণতান্ত্রিক বিধান (অনুচ্ছেদ নং ৬, ৭, ৮, ৯) রয়েছে, যেগুলো সরাসরি বাতিল করা না হলে হলসমূহে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করা একেবারেই অসম্ভব হবে। সেইসাথে হলসমূহের অভ্যন্তরে পরিবেশগত অবস্থা, খাদ্যের সুষমতা ও পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থীর প্রতি যেকোন অন্যায্য আচরণ বা নির্যাতন নিরোধ- ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রয়োজনবোধে নতুন সম্পাদকীয় পদ সৃষ্টি করে সরাসরি শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়া অতি প্রয়োজন। তা না হলে হল সংসদ দিনশেষে (অনুচ্ছেদ নং ২ অনুসারে) শুধু ক্রীড়া আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করার মাধ্যম হয়েই রইবে, আধুনিক যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে উপযুক্তভাবে কাজ করতে পারবে না।

নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ডাকসু ও হল সংসদসমুহের নির্বাচিত নির্বাহী কমিটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কার্যকরী ও কল্যাণমুখী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এসব সংকট থেকে উত্তরণের উপায়টা খুবই সরল- সোজা:- উপযুক্ত সংস্কার। যেহেতু সংস্কারের এখতিয়ার শুধুমাত্র সিন্ডিকেটের হাতে রয়েছে এবং এখন একটি নিরপেক্ষ সিন্ডিকেট ও প্রশাসন ক্ষমতায় রয়েছে, তাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সহ সকল অংশীদারের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের এই প্লাটফর্মকে কার্যকরী করে তোলার জন্য গঠনতন্ত্র সংস্কার করার এটিই সর্বোত্তম সময়। এছাড়াও ডাকসু’কে উপযুক্তভাবে জোরদার করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ এর প্রয়োজনীয় সংস্কারসমূহও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সহজতর উপায়ে করা যাবে।

কিন্তু দিনশেষে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে তোফাজ্জল হত্যাকান্ড, গণিত ভবনে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার, মেট্রোরেলের পিলার থেকে খুনি হাসিনার ঘৃণাস্তম্ভ মুছে ফেলা, চারুকলায় খুনি হাসিনার মোটিফে আগুন লাগানো, ছাত্রদল নেতা শহীদ এস এম শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকান্ড এবং বারংবার ককটেল বিস্ফোরণের মতন আতঙ্ক উদ্রেককারী ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন যেমন নিজেদের অথর্বতার ন্যাক্কারজনক প্রদর্শনীর মাধ্যমে ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি ডাকসু ও হল সংসদসমূহকে উপযুক্ত সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও এই প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে একটি ব্যর্থতা দিয়ে আরেকটি ব্যর্থতার স্মৃতিকে কৃত্রিমভাবে মুছে ফেলার নিয়মিত অপচেষ্টা করার যে অপরাজনীতি, সেটিকে এই প্রজন্ম ভয়ংকর অত্যাচারী ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের শাসনকে ধূলিসাৎ করার মাধ্যমে একবার ধ্বংস করে এসেছে। একই কায়দায় সাময়িকভাবে স্বার্থ হাসিলে সফল হলেও অন্যায়ের অনিবার্য পরিণাম হিসেবে আসা ধ্বংসকে যারা আগে থেকে আঁচ করতে পারেন না, তাঁদের হঠকারিতার ফলে আসা অন্ধকার ভবিষ্যতের ঘূর্ণিঝড় প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্থ করার বদলে তাঁদের নিজেদেরকেই এ জাতির স্মৃতিপট থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে- সেই আশাতেই আমি আশাবাদী হই।

মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী

দপ্তর সম্পাদক (যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদা), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।